ভারতীয় রুপিতে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সূচনা অনুষ্ঠানে হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মার বক্তব্য বিবৃতি ও বক্তৃতা

ভারতীয় রুপিতে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সূচনা অনুষ্ঠানে হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মার বক্তব্য

ভারতীয় হাই কমিশন

ঢাকা

ভারতীয় রুপিতে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সূচনা অনুষ্ঠানে হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মার বক্তব্য

সম্মানিত আব্দুর রউফ তালুকদার, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক,

জ্যেষ্ঠ সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়,

এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা),

সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়,

এফবিসিসিআই, আইবিসিসিআই, বিজিএমইএ, ডিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্টগণ

এমসিসিআই, বিকেএমইএ-এর ভাইস প্রেসিডেন্টগণ

সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও

ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও, ইস্টার্ন ব্যাংক

বাংলাদেশস্থ স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কান্ট্রি হেড

আইসিআইসিআই ব্যাংকের কান্ট্রি হেড

বাংলাদেশের ব্যাবসায়িক নেতৃবৃন্দ এবং শীর্ষস্থানীয় ব্যাবসায়িক চেম্বারসমূহের সদস্যগণ,

ব্যাংকিং ভ্রাতৃসংঘের সদস্যগণ, এবং মিডিয়ার বন্ধুগণ,

ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ,

    আজকের এই যুগান্তকারী অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত, যেখানে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় রুপিতে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের সূচনা ঘোষণা করছি।

২. গত এক দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং সেই রূপান্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশগুলোর মধ্যে একটি হলো আমাদের স্পষ্টত ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং যোগসূত্র।

৩. আজ, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বব্যাপী পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। গত পাঁচ বছরে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। গত অর্থবছরে তা প্রথমবারের মতো দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। বৈচিত্র্যময় বাজারের অধিকারী ভারত এশিয়ায় বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

৪. গত বছরের দিকে, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করেছে। উদ্বেগের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি যা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কোভিড অতিমারি সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য শক্তিশালী হয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছলেও, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মন্দা গত অর্থবছরে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছে।

৫. আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের গতি ধরে রাখতে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উত্থান-পতন থেকে যতটা সম্ভব এটিকে দূরে রাখার জন্য তাই গত কয়েক মাস ধরে উভয় পক্ষের এই প্রচেষ্টা।

৬. এই উদ্দেশ্য সাধনে, আমাদের দুটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক - বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক – ভারতীয় রুপিতে (আইএনআর) দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের নিষ্পত্তি শুরু করার জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ভারতীয় এবং বাংলাদেশি ব্যাংকসমূহকে মনোনীত করে এই নতুন ব্যবস্থা শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে, যা আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কিছুটা কমানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। বর্তমানে চিহ্নিত ভারতীয় ব্যাংকসমূহ হলো স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং আইসিআইসিআই ব্যাংক, আর মনোনীত বাংলাদেশি ব্যাংকসমূহ হলো সোনালী ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড৷ ভারতীয় রুপিতে (আইএনআর) দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত বাংলাদেশি ব্যাংকসমূহের প্রতিটিকে মনোনীত ভারতীয় ব্যাংকগুলোতে একটি স্পেশ্যাল রুপি ভোস্ট্রো অ্যাকাউন্ট (এসআরভিএ) খুলতে হবে৷

৭. ভারতীয় রুপিতে (আইএনআর) আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াটি আরও ভালোভাবে বুঝতে সবাইকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠানে পরবর্তীতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত প্রেজেন্টেশান উপস্থাপনা করা হবে। আমরা চিহ্নিত রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকদের মধ্যে ক্রেডিট পত্র (এলসি) বিনিময়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় রুপিতে (আইএনআর) বাণিজ্য শুরু করবো।

বন্ধুগণ,

৮. এই নতুন প্রক্রিয়াটির সুস্পষ্ট সুবিধা রয়েছে। এটি বাণিজ্য নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা কমিয়ে দেবে এবং ব্যবসায়ীদের মুদ্রা বিনিময় ব্যয়ের কিছু অংশ সঞ্চয়ের সুযোগ দেবে। মূলত, এই প্রক্রিয়াটি আমাদের নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের নিশ্চয়তা আনয়নে সহায়তা করবে।

৯. কিন্তু আমি এটিকে অধিক গতি, উন্নততর কার্যকারিতা ও বাণিজ্য নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আরও বেশি সুবিধার দিকে রূপান্তরিত হতে দেখছি, কারণ আমরা মুদ্রান্তর ও বিদেশি মুদ্রায় এলসি খোলার ঝামেলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। উপরন্তু, বাণিজ্য করার জন্য একাধিকবার মুদ্রান্তরের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করা আমাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বৃহত্তর বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সূচনা ঘটাবে, যার ফলে বাণিজ্যের পরিমাণ সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। বাণিজ্যের সহজীকরণ নিয়ে কাজ করা ব্যাংকগুলোও এই পদ্ধতি ব্যবহার করে লেনদেনের খরচ কমানোর মাধ্যমে উপকৃত হবে। সামগ্রিকভাবে, এই ব্যবস্থাটি আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন বিকল্প প্রদান করবে, লেনদেনের খরচ ও সময় কমিয়ে দেবে এবং ব্যবসাকে আরও সহজ করবে।

১০. এই প্রক্রিয়াটি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের চাহিদার একটি ফল, এবং আমার দৃষ্টিতে, দীর্ঘমেয়াদে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরও উন্নত করার অসাধারণ সম্ভাবনা এর রয়েছে। কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা), যার জন্য আমরা শীঘ্রই আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি, এবং এই নতুন প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা আশা করি যে, এগুলো আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করবে

এবং এটিকে দ্রুত প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার মাধম্যে একটু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উত্তরণ ঘটাবে।

১১. আজকের অনুষ্ঠানটি আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারত্বের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং এই নতুন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মন্ত্রণালয়সমূহের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাই যাঁরা আজকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এবং তাঁদের চিন্তাধারা বিনিময় করেছেন। আমি বিশেষ করে গভর্নর তালুকদারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্রমাগত দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য, এবং আজ এটিকে বাস্তবায়িত করার জন্য। আমি চারটি মনোনীত ব্যাংকের প্রধানদেরও এই প্রক্রিয়া শুরু করার ক্ষেত্রে তাঁদের তৎপরতা ও দ্রুততার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমরা চাই, ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ থেকেই আরও ব্যাংক এই ব্যবস্থায় যোগদান করুক।

বন্ধুগণ,

১২. পরিসমাপ্তির আগে, আমি বলতে চাই যে, উভয় পক্ষই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, ক্রমবর্ধমান দৃঢ়সংকল্প ও সাগ্রহ ইচ্ছার সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক বন্ধনে নতুন গতি যোগ করতে এগিয়ে এসেছে। আমরা কোভিড অতিমারির কারণে সৃষ্ট প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি এবং সেটা থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছি। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব রাখা বৈশ্বিক প্রতিকূল অবস্থা, আরেকটি প্রতিবন্ধকতার উদ্ভব ঘটিয়েছে। এটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক এবং আমাদের দ্বিপাক্ষিক অংশীদারত্বের স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক যে, আমরা এই উদ্ভাবনী ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক ও আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগসমূহের সঙ্গে আবারও খাপ খাইয়ে নিচ্ছি। এটি যৌথ উন্নয়ন ও যৌথ সমৃদ্ধির প্রতি আমাদের অঙ্গীকারেরও প্রতিফলন।

১৩. আমি নিশ্চিত যে, আপনাদের মধ্যে অনেকেরই এই প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন থাকবে। তবে আপনাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এটি কেবল সূচনা, তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচনা। আমাদের যাত্রায় উভয় পক্ষকেই এই প্রক্রিয়াটিকে পরিমার্জন করে আরও ভালো প্রক্রিয়ায় পরিণত করার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে এবং উন্নতিসাধন করতে হবে।

১৪. আবারও, আজকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য এবং এই অনুষ্ঠানটিকে বিশাল সাফল্যে পরিণত করতে সহায়তা করার জন্য আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বিশেষ করে মিডিয়া ও ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলের সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে চাই, যাঁরা আজকের অনুষ্ঠানের অগ্রগতির বিষয়টি আগ্রহের সঙ্গে আগে থেকেই অনুসরণ করেছেন। এই ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করবে এই প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান ও ব্যবহারের ওপর এবং আজকের এই অনুষ্ঠান আমাদের সকলকে ঠিক এই কাজটি করতে অনুপ্রাণিত করে।

১৫. আমরা মধ্যাহ্নভোজ পরবর্তী অধিবেশনে চারটি মনোনীত ব্যাংকের সভাপতিত্বে একটি সংক্ষিপ্ত কর্মশালার আয়োজনও করেছি, যেখানে এই প্রক্রিয়া সম্পর্কিত আপনাদের সকল প্রশ্ন আরও বিশদভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। আমরা এখানে উপস্থিত সকল ব্যবসায়িক চেম্বার এবং ব্যাংকের সদস্যদের এই অধিবেশনে যোগ দিতে উত্সাহিত করছি৷

আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরজীবী হোক!

***